বড়াল একটি নদী। নদীমাতৃক বাংলাদেশ বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ নদী যার মা। করো মা যদি অসুস্থ থাকে তাহলে তিনি কি ভালো থাকতে পারেন। এমন প্রশ্নের উত্তরে সকলেই এক বাক্যে বলবেন না। কিন্তা আমরা আমাদের মা স্বরুপ নদীকে অসুস্থ নয় সরাসরি হত্যা করতে কার্পন্য করছি না। প্রতিনিয়ত নানান ধরণের বর্জ্য ফেলে, নদীর পাড় দখল করে দিন দিন বড়াল নদীকে অসুস্থ করে হত্যা করার জোর চেষ্টা চলছে। সে বিষয়ে আমাদের কারো কোনো নজর নেই। অপর দিকে আমাদের উর্ব্ধতন কর্তৃপক্ষেরও তেমন মাথা ব্যাথা নেই। অথচ বৃহত্তর চলনবিল (পাবনা-নাটের-সিরাজগঞ্জ এর অংশ জুড়ে)নামে খ্যাত এই বিলে রয়েছে হাজার হাজার একর জমি। বর্ষা মৌসুমে একদিকে প্রচুর মাছ উৎপন্ন হয় অন্যদিকে অবাদী গুলিতে হাজার হাজার টন ফসল উৎপাদন হয়। যা দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। কিন্তু চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বড়াল, গুমানী ও করোতেয়াসহ বেশ কয়েকটি নদীর শাখা। দেশের বৃহত্তর বিলগুলির মধ্যে অন্যতম চলনবিলের বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কানে নদী গুলি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। পানি নেমে যাওয়ার পর পরই এই বিলের হাজার হাজার একর জমিতে কৃষকে স্বপ্নের বাস্তবায়ন করে থাকেন। কিন্তু নদী গুলিতে ময়লা বর্জ্য ও অবৈধ্য দখল করে তিলে তিলে খুন করতে থাকলে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বড় ধরনের আঘাত আসবে। তাই বড়াল রক্ষায় উব্ধর্তন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছেন।
বড়াল নদী গঙ্গার একটি শাখা নদী । এই নদী রাজশাহী জেলার চারঘাটের কাছে উৎপন্ন হয়ে নাটোর ও পাবনা জেলার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে শাহজাদপুরের দক্ষিণে করতোয়ার সঙ্গে মিলিত হয়ে হুরাসাগরে পড়েছে। বড়াল নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫০ কিমি। গড় প্রস্থ ১২৫ মিটার এবং গড় গভীরতা প্রায় ৬ মিটার। বড়াল নদীটি গঙ্গা থেকে শুধুমাত্র বর্ষা মৌসুমে প্রবাহ লাভ করে। বৎসরের অন্যান্য সময়ে চলনবিলসহ স্থানীয় বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল থেকে পানি প্রবাহ করে থাকে। বড়ালের পানি নিষ্কাশন চলনবিল এলাকা প্রায় ২৩০ বর্গ কিমি। রাজশাহী জেলার চারঘাট, বাগতিপাড়া, বড়ইগ্রাম, নাটোর, গুরুদাসপুর পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও বেড়া এই নদীর তীরে অবস্থিত উল্লেখযোগ্য স্থান।
উত্তর জনপদের অন্যতম একটি নদী যার নাম বড়াল। অথচ বড়াল নদীর পাড় দখলকৃত বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে বাড়িঘর, সরকারি-বেসরকারি অফিস নির্মাণ ও হাউজিং প্লট তৈরি করেছেন প্রভাবশালীরা। নদীর ওপর দিয়ে ক্রমাগত বাঁধ, স্লুইসগেট, ক্রসবাঁধ নির্মাণ করায় এর গতি রুদ্ধ হয়ে গেছে। অপরদিকে নদী-তীরবর্তী শহরের অগণিত পোলট্রি ফার্ম, হাসপাতাল, বেসরকারি ক্লিনিক, হোটেল, কলকারখানা, বসত-বাড়ির বর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশনে মৃত প্রায় বড়াল দূষিত ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
জানা গেছে,এক সময় এ নদীর ওপর নির্ভরশীল ছিল চলনবিলে প্রবহমান বড়াল,নন্দকুজা, চিকনাই, ও গুমানীসহ বেশ কয়েকটি নদ-নদী এবং নদী-তীরবর্তী প্রায় ৫০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা। বড়াল নদী চার জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হলেও পুরো চলনবিল অঞ্চলের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে আরো ২০টি উপজেলায় এই নদীর প্রভাব আছে। দেশের বৃহত্তম দুটি নদী পদ্মা ও যমুনা এবং বৃহৎ জলাভূমি চলনবিলের মধ্যে প্রধান সংযোগ রক্ষাকারী নদী বড়াল। এ নদীর সঙ্গে যুক্ত আছে প্রায় শতাধিক খাল। একেকটি খালের সঙ্গে যুক্ত আছে চার-পাঁচটি করে বিল। এ কারণে বড়ালের অববাহিকায় নানা স্থানে প্রতিবন্ধকতার কারণে পানির প্রবাহ রুদ্ধ হওয়ায় চলনবিলের অধিকাংশ বড়ো বড়ো নদ-নদীতে নাব্য-সংকট চরম হয়ে দেখা দিয়েছে।
বড়াল নদীকে ঘিরে এই এলাকার অধিকাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা ছিল সুখ-সমৃদ্ধির। এক দিকে যেমন হাজার হাজার কৃষকের ভাগ্য জড়িত। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা অনেকটাই নির্ভর করে। আর এই বিল পাড়ে বসবাসরত লাখলাখ মানুষের ভাগ্য জড়িত। কিন্তু বড়াল নদী প্রভারশালীদের ক্রমাগত দখলে নিয়ে অট্টালিকা নির্মাণ আর দূষনে দিনের পর দিন বড়াল মরে যচ্ছে। আর বড়াল মরে যাওয়ায় নৈর্সগিক চেতনা হারাচ্ছে।
তবে সুসংবাদ হলে বড়াল রক্ষার তাগিদে ২০০৮ সালের ২ আগস্ট গঠিত হয় বড়াল রক্ষা আন্দোলনের একটি কমিটি। এই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বড়াল নদীর উপর নির্মিত নুরনগর, দহপাড়া, চাটমোহর নতুন বাজার, বোথড় ও রামনগর ক্রশ বাঁধ অপসারণ হয়েছে। পদ্মা-যমুনার সঙ্গেই বড়াল নদীকে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় আনার দাবি করেন বড়াল রক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আন্দোলনকারীরা। পাশাপাশি বড়ালের পাড়ে অবৈধ্য দখল নির্মিত ভবনসহ প্রভাবশালী মহলের অট্টালিকা উচ্ছেদ করে নদীর প্রাণ ফিরে আনার দাবী জানিয়েছেন নদী রক্ষাকায় আন্দোলনকারী।
Leave a Reply