মোঃ শফিউল আযম, বেড়া ঃ সেচ মওসুমে ভারত উজানে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি একতরফা প্রত্যাহার করে সেচের জন্য উত্তরবঙ্গের কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদহ জেলায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এর বিরুপ প্রভাবে শীতকালেই তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র নদ মরা নদীতে পরিনত হয়েছে। পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় তিস্তার বুকে ধু ধু বালু চর। তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের মিলিত প্রবাহের যমুনায় জেগে উঠেছে বিশাল বিশাল চর। নদীর মুলধারা সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়েছে। এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ, পানিসম্পদ, কৃষি অর্থনীতি হুমকীর মুখে পড়েছে। প্রায় ৮০ ভাগ নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে ।
ভারত থেকে আসা ব্রক্ষপুত্র ও তিস্তার প্রবাহ একসঙ্গে ধারন করে যমুনা নদী বিশাল জলরাশি নিয়ে বির্স্তীর্ণ জনপদের ভেতর দিয়ে প্রবাহমান ছিল। কিন্তু ভারত তিস্তা ও ব্রক্ষপুত্রে নদে বহুসংখ্যক জলবিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্প নির্মাণ করেছে। ফলে এর বিরুপ প্রভাব পড়েছে যমুনা নদীতে। ইতোমধ্যে যমুনার পানির প্রবাহ কমে গেছে। আর নদীর বুক ভরাট হয়ে অসংখ্য ছোট-বড় চর জেগে উঠছে। সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ছে নদীর মুলধারা। স্থানীয়রা জানান, ২২ বছর আগে তিস্তা নদী দিয়ে যেসব কার্গো জাহাজ চলত এখন এই নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে।
হিমালয় পর্বতমালার উৎস থেকে যে কয়টি দেশ পানির বিপুল সম্ভার লাভ করে থাকে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এসব নদীর প্রবাহ সরাসরি বাংলাদেশ পেতে পারে না। ভারতের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি নদীর প্রায় সবক’টি নদী ও উপনদীতে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সেচের জন্য বিপুল পানি ভান্ডার সরিয়ে নিচ্ছে। তারা গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, দুধকুমার, ধরলা ও মহানন্দাসহ হিমালয় অঞ্চলের অভিন্ন নদী ও উপনদীতে ভারত বাঁধ নির্মান করেছে। নেপাল ও ভুটানে ভারত বাঁধ নির্মাণ করেছে। প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে এসব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ফলে ভাটির বাংলাদেশে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ভারত গজলডোবায় তিস্তার ওপর যে ব্যারেজ নির্মাণ করেছে তার ফলে তিস্তার ভারতীয় অংশে পানি থৈই থৈই করছে। আর ভাটির বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় জেগে উঠছে অসংখ্য ধুধু বালু চর। তিস্তার পানি সরিয়ে নেয়ার জন্য তৈরি ‘তিস্তা-মহানন্দা মূল ক্যানেল’-এর সাহায্যে শুকনো মওসুমে তিস্তার প্রবাহ থেকে ১৫০০ কিউসেক পানি মহানন্দা নদীতে নিয়ে যাচ্ছে। তিস্তা-মহানন্দা লিংক ক্যানেলের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬ কিলোমিটার। এই ক্যানেলের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৭৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরন খালের সংখ্যা ১০টি। এই সংযোগ খাল থেকে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিম দিনাজপুর, কোচবিহার, মালদাহ জেলার কৃষি জমিতে সেচের পানি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
এদিকে মহানন্দা প্রধান ক্যানেলের দৈর্ঘ্য ৩২ কিলোমিটারের বেশি। এই ক্যানেলের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৭১ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরন খালের সংখ্যা ১৩টি। ডাউক নগর প্রধান ক্যানেলের দৈর্ঘ্য ৮০ কিলোমিটারের বেশি। এই ক্যানেলের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৯৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরন খালের সংখ্যা ১৮টি। নাগর টাঙ্গন প্রধান খালে দৈর্ঘ্য ৪২ কিলোমিটারের বেশি। এর মাধ্যমে বছরে এক লাখ ১৬ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরন খালের খংখ্যা আটটি। তিস্তা-জলঢাকা প্রধান ক্যানেলের দৈর্ঘ্য ৩০ কিলোমিটারের বেশি। এর মাধ্যমে ৫৮ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরন খালের সংখ্যা ছয়টি।
ভারত ব্রহ্মপুত্রের অন্যতম উৎস ও প্রদায়ক রাঙ্গানদীর উপর বাঁধ নির্মান করেছে। ব্রহ্মপুত্রে পানির প্রবাহ হ্রাস পাওয়া এর অন্যতম কারন বলে জানা গেছে। আসামে ব্রহ্মপুত্র নদের অন্যতম উৎস পাগলাদিয়ায় একটি বিশাল বাঁধ নির্মান করছে ভারত। এই বাঁধের মাধ্যমে ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা স¤প্রসারন করা যাবে। এজন্য পাগলাদিয়ার পানি বাঁধের ভেতর প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এতে বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অংশে পানির সঙ্কট হচ্ছে। ভারত ব্রহ্মপুত্রের আরেক উৎস লাংপি নদীর উপর একটি বাঁধ তৈরি করে পানির প্রবাহ আটকে দিয়েছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনার প্রবাহের গুরুত্বপূর্ণ উৎস রাইডাক নদীতে ভুটান-ভারত যৌথ উদ্যোগে বৃহৎ একটি পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। এই প্রকল্পের জন্য যে পরিমান পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে তাতে ব্রহ্মপুত্র নদে পানির সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের অপর গুরুত্বপূর্ণ উৎস কপিলি নদীকে কেন্দ্র করে ভারত বেশ ক’টি বাঁধ ও রিজার্ভার নির্মান করেছে। সেচ ব্যবস্থার স¤প্রসারনের পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন এই বাঁধ প্রকল্পের লক্ষ্য। এটি নির্মিত হওয়ায় ব্রহ্মপুত্রে পানি প্রবাহে সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে যমুনা নদীতে পানির প্রবাহে টান পড়ছে। এই প্রকল্পের আওতায় ব্রহ্মপুত্রের উপনদী উমিয়ামের পানি সরিয়ে নিয়ে উপক্র নামক নদীতে প্রবাহিত করা হচ্ছে। পানি প্রত্যাহারের ফলে কার্যত এই অন্যতম উপনদীর পানি থেকে ব্রক্ষপুত্র নদ প্রায় সম্পূর্ণ বঞ্চিত হচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, তিস্তার ভারত অংশের একেবারে ভাটিতে বাংলাদেশের কাছে ব্যারেজ নির্মাণ ও ডাইভারশন খাল কেটে মহানন্দা নদীতে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। এছাড়া উত্তরবঙ্গের কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদহ জেলার নয় লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে তিস্তার পানি দিয়ে সেচ দেয়ার জন্য ভারতের বিশাল পরিকল্পনা আছে।
নদী বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তিস্তার উজানে ভারত ইতোমধ্যে অসংখ্য প্রকল্প নির্মাণ করে ফেলেছে। আরো প্রকল্প নির্মাণাধীন রয়েছে। এসব প্রকল্পের প্রতিক্রিয়ায় তিস্তার ভাটিতে পানির প্রবাহ আরো কমবে। বাংলাদেশ অংশে বাড়বে সঙ্কট। শুস্ক মওসুসে তিস্তায় পানি প্রবাহ কমে দাঁড়ায় মাত্র ২০০ কিউসেক। এতে ধরলা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, আখিরা, দুধকুমার, বুড়ি তিস্তাসহ যমুনা নদীর পানি প্রবাহ কমে যাবে। রংপুর ও বগুড়া অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে।
অন্যদিকে তিস্তায় পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা সেচ প্রকল্প স্থবির হয়ে পড়েছে। সেচ প্রকল্প এলাকায় সাত লাখ হেক্টর জমিতে প্রতি বছর শুস্ক মওসুমে পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দেয়। এ কারণে গত কয়েক বছরে এই অঞ্চলের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে হচ্ছে, যা এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে ক্রমাগত পঙ্গু করে দিচ্ছে।
Leave a Reply